বৃহস্পতিবার, ১ জুন, ২০১৭

প্রবন্ধ

অপসংস্কৃতির বিভীষিকা
সাদেক আহমেদ
..................
সৃষ্টির সেরা মানবজাতি। মানুষের আছে অন্যের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, আশা-হাতাশা ও ভালো-মন্দ বুঝবার অসীম ক্ষমতা এবং প্রয়োজনে সিদ্ধান্ত গ্রহন ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নেও সে সক্ষম। বাঁচার তাগিদে মানুষকে কত কিযে করতে হয়, তার কোন নিদিষ্ট পরিসংখ্যান নেই। ব্যাক্তি পর্যায় থেকে সমষ্টিগত পর্যায়ে কর্মকা- ও জীবনধারায় দেখা যায় বিচিত্র রূপ। এরই মাঝে গড়ে উঠে মানুষের সংস্কৃতি। প্রকৃতির বিধান মেনে নারী- পুরুষের বিবাহবন্ধন, সন্তানজন্মদান, তাকে লালন-পালন ইত্যাদি নানা কারনে গড়ে উঠে পরিবার ও সমাজ। সে সমাজে প্রতিটি মানুষকে নানাবিধ নিয়ম-নীতি, শৃঙ্খলা, নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের মধ্য দিয়ে মানুষ জীবন যাপন করে। বিস্তার লাভ করে তার সংস্কৃতির। প্রতিটি জাতি তার নিজস্ব সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে শান্তির দীপ জ্বালিয়ে ক্রমাগত আলোর পথে এগিয়ে চলে। নিজস্ব সংস্কৃতি ও ভাষার প্রতি তাদের মনের গভীরে জন্ম নেয় ভালোবাসা। মানব সভ্যতার ঊষালগ্নে পশুশিকার, পাথর দিয়ে অস্ত্র তৈরি ও গাছের পাতা দিয়ে মানুষ নিজের লজ্জাস্থান ঢেকে রাখতো। পরবর্তী সময়ে মানুষ বস্ত্র বানাতে শেখে, জীবিকার জন্য সে আয়ত্ত করে নানাবিধ কৌশল, উৎপাদন করতে শেখে রকমারি ফসল। ফলে উন্নত হয় জীবনমান। সংস্কৃতির বিকাশের ফলে মানুষ গান গাইতে শেখে, বিস্তার লাভ করে নৃত্য, চিত্রকলা ও সাহিত্য। আমাদের এই ভূখ-ে বহুজাতি, সংস্কৃতি ও ভাষার মানুষ সুদীর্ঘ সময় যাবত বসবাস করে আসছে। প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। হাজার বছর ধরে প্রত্যেক জাতি তার নিজস্ব সংস্কৃতি এ অঞ্চলের মাটি ও জলবায়ুতে স্বাধীনভাবে চর্চা করে আসছে। নিজস্ব সংস্কৃতি,ঐতিহ্য, লোকাচার ও রীতি-নীতি তারা বংশ পরম্পরায় মেনে আসছে। নিজেদের সংস্কৃতির মাঝে তারা খোঁেজ পেয়েছে শান্তি ও স্বস্তি। শান্তির অন্বেষায় ঐক্য, সাম্য ও ভ্রাতৃত্তের বন্ধন হয় আরো সুদৃঢ়। আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিতে রয়েছে নানাবিধ গান, কবিতা, ছড়া, গল্প, নাটক , উপন্যাস ও প্রবন্ধ। নিজেদের সংস্কৃতির পরিচয় পাওয়া যায় এসবের মধ্যে দিয়ে। অতীত ও বর্তমানের মাঝে তৈরি হয় সেতুবন্ধন। তাই মানবতাবোধ ও দেশপ্রেমে উদ্বোদ্ধ জাতি গঠনে নিজস্ব সংস্কৃতি চর্চার বিকল্প নেই। একই ভূখন্ডে বসবাসকারী ভিন্ন ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে মেলামেশা, উঠাবসা ও যোগাযোগের ফলে সংস্কৃতির মিশ্রণভাব লক্ষ করা যায়। কোন নির্দিষ্ট জাতির নিজস্ব সংস্কৃতিতে ভিন্নদেশী সংস্কৃতির অবাধ অনুপ্রবেশের ফলে ক্ষতিগ্রস্থ হয় সে জাতির সংস্কৃতি। নিজন্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক বাহক যে জনগোষ্ঠী তাদের চিস্তা-চেতনা ও রুচিবোধের পরিবর্তন দেখা যায়। ফলে ব্যক্তি সমাজ ও রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্থ হয়। সমাজে বৃদ্ধি পায় অস্থিরতা, অশাস্তি ও হতাশা। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার ফলে এদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের লেখাপড়া না জানা মানুষটির মাঝেও সেটেলাইট চ্যানেলের বদৌলতে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের আচার-আচরণ, পোষাক-পরিচ্ছদ ও চলনবলন দেখবার সুযোগে তাদের চিন্তা-চেতনা ও মনোভাবের পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। ফলে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নৈতিক উদারতার নামে মুক্তবাজার অর্থনীতির ন্যায় অবাধে চলে বিদেশি সংস্কৃতির বাণিজ্য। ডিজে পার্টি,সাম্বানৃত্য ও কাপলডান্স পশ্চিমা সমাজের সংস্কৃতি হতে পারে। কর্মক্লান্ত নাগরীক জীবনে দেহের ক্লান্তি দুর করবার জন্য নেশাজাতীয় পাণীয় পান করে নারী-পরুষ নগ্ন বা অর্ধনগ্ন হয়ে নৃত্য করা, গাড়ীর চাবি বদলের মধ্য দিয়ে স্ত্রী বদল করা পশ্চিমাদের সংস্কৃতি হতে পারে, কখনো তা বাঙালির সংস্কৃতি হতে পারে না। বাঙালি নারী তার সম্ভ্রমকে সতিত¦ হিসাবে জানে। সমাজ রাষ্ট্র ও ধর্মমতে যাকে সে স্বামী হিসেবে জানে তাকেই কেবল সে তার রূপ-যৌবন ও সম্ভ্রমের অংশীধার হিসাবে জানে ও সর্বান্তকরনে মানে। শত প্রয়োজন ও সংকটেও কোন বাঙালি নারী একমুহূর্তের জন্যেও অন্য কোন পরুষকে তার শয্যাসঙ্গী মেনে নিতে পারে না। চরম প্রতিকুলতায়ও অসংখ্য বাঙালি নারী জীবন দিয়ে তার প্রমাণ দেখিয়ে গেছে । মধ্যপাণ ও যৌন উত্তেজক ঔষধ সেবন করে নগ্ন বা অর্ধনগ্ন অবস্থা চাইনিস রেষ্টুরেণ্টে নাচ-গান করে বিনোদন করা অন্য কোন দেশের সংস্কৃতি হতে পারে, কখনো তা বাঙালির সংস্কৃতি হতে পারে না। এদেশের যুব সমাজ সুদুর অতীতকাল থেকে যাত্রাপালা, পালাগান, কবিগান ও সার্কাসসহ অনেক শুদ্ধ সংস্কৃতির অনুষঙ্গ চর্চা করে এসেছে, যে গুলো বাঙালি সংস্কৃতির ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে এবং নিজস্ব ইতিহাস-ঐতিহ্য সচেতন ও জাতীয়তাবোধ সমৃদ্ধ জাতি গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে আসছে। বৃদ্ধ বয়সে বাবা-মা হবেন প্রবীন নিবাসের বাসিন্দা পশ্চিমা বিশ্বে এ সংস্কৃতি প্রশংসীত হলেও হতে পারে তবে বাঙালি সমাজে এ নিয়ম কখনো প্রশংসার যোগ্য নয়। বাঙালি পরিবারের শিশুরা জন্মের পর থেকে শৈশব ও কৈশোর কাটে বৃদ্ধ দাদা-দাদির ঘনিষ্ঠতা ও অত্যান্ত মায়া-মমতার ছায়ায়। বৃদ্ধ বয়সের এই প্রাজ্ঞ লোকদের আচার-আচারণ দেখে শিশুর মন ও মানুষিকতায় সৃষ্টি হয় পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও মানবিকমূল্যবোধ।বিশ্ব জুড়ে আমাদের জাতি সত্তার যেমন গৌরবোজ্জল পরিচিতি আছে তেমনই আছে এক সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ইতিহাস। বর্তমানে সাংস্কৃতির যে সুনামী চলছে আমাদের দেশে, তাতে গা না ভাসিয়ে আমাদের ভাবতে হবে কোন ধরনের সংস্কৃতি আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র ও জাতিসত্তার জন্য মানানসই। পোষাক-পরিচ্ছদে অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা, বিনোদের নামে পতিতাবৃত্তি ও অবাধ যৌনতাকে কখনো সংস্কৃতি বলা যায় না।
এ দেশরে মানুষের সংস্কৃতিতে ছিল মানবতাবোধ,শালীনতাবোধ,উৎকৃষ্ট নৈতিকতাবোধ তবে কালক্রমে সবেই যেন আজ বিলীনের পথে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন