সোমবার, ২৭ জুলাই, ২০২০

প্রবন্ধ

ছড়াসহিত্যের গুরুত্ব
সাদেক আহমেদ
মানুষের জীবনবোধ,সামাজিক অবস্থা ,সমাজব্যবস্থা,রাষ্ট্রব্যবস্থা,রুচিবোধ,মূল্যবোধ,বিনোদন প্রণালি ও প্রক্রিয়া নিয়ত পরিবর্তনশীল। তাই মানুষ যুগ থেকে যুগান্তরে কাল থেকে কালান্তরে নতুন কিছুর সাথে পরিচিত হয় ।যাকিছু পুরাতন,যা তার পূর্ব পুরুষের যাপিত জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলো তাকে জানবার এবং তাকে লালন করবার মানুষের মধ্যে যে কৌতুহল তাকে বলা হয় শেকড় সন্ধানী। শকড় সন্ধানী মনের কৌতুহল নিয়ে মানুষ আশ্রয় নেয় লোকসাহিত্যের তথা ছড়া,কবিতা,গান,গীতিকাব্য,পুথি,জারিগান,শ্লোক,ধাঁধাঁ ,জনশ্রুতি ইত্যাদির। এর মধ্যে মানুষ জানতে পারে তার পূর্বপুরুষের জীবনের মান কেমন ছিলো,সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা কেমন ছিলো, মানুষের নীতিবোধ ও মূল্যবোধ কেমন ছিলো তাদের চিন্তা ও কর্মের অনেককিছু খোঁজে পাওয়া যায় লোক সাহিত্যের মাধ্যমে।ভৌগোলিক অবস্থা বিবেচনায় আমাদের এই অঞ্চলের ভূমি অত্যন্ত উর্বর,জলবায়ু অনেকটা আরামপ্রদ,ছয় ঋতুর এই অঞ্চলে ঋতু বদলের সাথে সাথে প্রকৃতিও তার রূপ বদলায়। তাই যাপিত জীবনের দু:খ কষ্ট,আনন্দ,বেদনা ছড়া,কবিতা ও গান ও গল্পের মাধ্যমে প্রকাশ করে মানুষ।মানুষের মূল্যবোধ,বিনোদন,চরিত্র গঠন,দেশপ্রেম সৃষ্টি সর্বোপরি মাটি ও মানুষের কল্যাণে ছড়া ও কবিতার চর্চা প্রাগৈতিহাসিক কালেও ছিলো এখনও আছে।পৃথীবিতে যত ধরনের আন্দোলন সংগ্রাম হয়েছে শোষণ নির্যাতন,নিপীড়ন জুলুমের বিরুদ্ধে,স্বকিয়তা ও সার্বভৌমত্তের দাবিতে সেখানেও ছড়া ও কবিতার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দেখা যায়। এদেশ থেকে ইংরেজদের বিতারিত করা,জমিদারি প্রথার বিলোপ সাধন,বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা,পাকিস্তানিদের এই দেশ থেকে বিতারিত করা, স্বাধিন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা,শ্বৈরশাসকের অবসান ঘটিয়ে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করাসহ নানা সময়ে নানা ধরনের প্রাকৃতি ও মানবসৃষ্টি দুর্যুগে গণমানুষকে সচেতন ও উদ্বোদ্ধ করণে ছড়া ও কবিতার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দেখা গেছে।স্বাধীনতা লাভের জন্য আমাদের যে মুক্তিযুদ্ধ তা কোন আকস্মিক ঘঠনা ছিলো না। এই অঞ্চলের গণমানুষের দীর্ঘ রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রামের চূড়ান্ত বহি:প্রকাশ ছিলো মুক্তিযুদ্ধ। এই যুদ্ধে ১৯৭১ সালে সংগঠিত হলেও এর পটভূমি তৈরি হয়েছিলো ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের মধ্য দিয়ে। তারপর ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের বিজয়ের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা লাভের প্রেরণা সৃষ্টি হয়। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন,১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন,১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন,১৯৬৯ সালেন ১১ দফা আন্দোলন এই সকল আন্দোলন সংগ্রামের সর্বক্ষেত্রেই ছড়া ও কবিতা ছিলো একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। ১৯৪০ সালে নবাব আলীবর্দী খাঁ এর শাসনামলে বর্গীদের অত্যাচার নিপীড়নে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে মুখে মুখে যে ছড়া কাটতো-খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো /বর্গী এলো দেশে,বুল বুলিতে ধান খেয়েছে/খাজনা দেবো কিসে?। ধান ফুরালো পান ফুরালো/খাজনার উপায় কী? আর ক’টা দিন সবুর কর /রসুন বনেছি।১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের সময় দীর্ঘ দিন একই ভাষাভাষি মানুষ এক সাথে বসবাস করায় তাদের মধ্যে যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন তৈরি হয়েছিলো তার মনোবেদনা এই ভাবে প্রকাশ করেছে-তেলের শিশি ভঙলো বলে /খুকুর পরে রাগ করো?তোমরা যে সব বুড়ো খোকা /ভারত ভেঙে ভাগ করো। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর অন্যায়,অত্যাচার ,অনাচার,বৈষম্যমূলক আচণ ও শোষণ নিপীড়নে প্রতিবাদী হয়ে মানুষ ছড়া কাটতো-ঢোল নাকড়া বাজা/ঢোলনাকড়া বাজা/দস্যুরাসব নিচ্ছে লুটে/জলদী দেগে সাজা/ঢোলনাকড়া বাজ/ঢোলনাকড়া বাজা/দস্যু মেরে ছিনিয়ে নে তোর /পাবার আছে যা যা । সেই সময়ের জনপ্রীয় আরও একটি ছড়া-চিমসে পেটে হাত বুলাও/ভাত না পেলে খাও পোলাও/তাও না পেলে বাতাস খেয়ে/আচ্ছা করে/পেট ফোলাও।এই সময়ের জনপ্রীয় আরও একটি ছড়া-ইয়ে আজাদী জুটা হ্যা/ লাখো ইনসান বুকা হ্যা। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার অপততপরতার বিরুদ্ধে এই ছড়াটি মানুষের মুখে মুখে শোনা যেতো-কায়দা আজম ফিরা যাও/উর্দু ভাষায় করে রাও/উর্দু ফার্সি ইংরাজি/পড়তে আমরা নিমরাজি। পাকিস্তানীদের পরাজয়ের পর মানুষের মুখে মুখে এ ছড়াটিও শোনা যেতো-বিড়াল ছানা মিনি/সবাই তাকে চেন/বলল আমি বাঘের মাসী/বাঘ হবো না কেন? সত্যি সেদিন বাঘ হয়ে সে/বসলো মোদের সনে/আমরা তাকে ভয় পেয়ে যে তাড়িয়ে দিলাম বনে।একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় ছড়াকারগণ যেভাবে মানুষকে উদ্বোদ্ধ করতো তা এই ছড়ায় লক্ষ্য করা যায়-ট্রাক!ট্রাক!ট্রাক!/শুয়োরমুখো ট্রাক আসবে/দুয়োর বেধেঁ রাখ।/কেন বাধঁবো দোরজানালা/তুলবো কেন খিল?/আসাদ গেছে মিছিল নিয়ে/ফিরবে সে মিছিল।ট্রাক!ট্রাক!ট্রাক!/ট্রাকের মুখে আগুন দিতে মতিয়ুরকে ডাক/কোথায় পাবো মতিয়ুরকে /ঘুমিয়ে আছে সে/তোরাই তবেসোনামানিক/আগুন জ্বেলে দে।মুক্তযুদ্ধ চলাকালে এই অঞ্চলের গণমানুষের মুখে মুখে শোনা যেতো যে ছড়া-ইলিশ মাছের তিরিশ কাটা/বুয়াল মাছের দাঁড়ি/টিক্কা খাঁন ভিক্ষ্ াকরে/ শেখ মুজিবের বাড়ি।নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে তার মর্যাদা রক্ষা ও সর্বক্ষেত্রে তার অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করতে যুগে যুগে সমাজ সংস্কারকগণ কাজ করেছে ফলে কন্যাসন্তানকে জীবন্ত কবর দেওয়া,স্বামী মারা যাওয়ার পর বিধবাকে আগুনে পুড়িয়ে মারা যেমন বন্ধ হয়েছে বাল্যবিবাহ কমেছে নারী এখন সমহিমায় নিজের যোগ্যতার প্রমান নিয়ে পুরুষের পাশাপাশি মর্যাদা সম্পন্ন জীবন যাপন করছে। এর নেপত্যে ছড়াসাহিত্যের রায়েছে অনন্য অবধান। ছড়ায় যেভাবে বর্ণনা করা হয়েছে-
বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদে এলো বান/ শিব ঠাকুরের বিয়ে হবে তিন কন্যা দান/এক কন্যা রাধেন বারেন আর এক কন্যা খান /আর এক কন্যা গোস্বা করে বাপের বাড়ি যান। এভাবে বিয়ের অনেক বিষয় ছড়াসাহিত্যের উপজিব্য হয়েছে।অনেক সময় ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা বর-কনে সেজে খেলা করে তাতে সংসারজীবনের চিত্রকল্প ফোটে উঠে। নারীজীবনের দু:খ-বেদনা,আশা-আশা,হতাশা পাওয়া না পাওয়া ইত্যাদি অবলম্বনে রচিত অয়েছে অনেক ছড়া।আমাদের সমাজে দাদা,দাদি, খালা,ফুফু ,নানা –নানী তারা ছোট ছোট শিশুকে নানা ধরনের ছড়া কেটে ঘুম পাড়ায়,আদর করে যেমনটি এই ছড়াগুলোতে দেখা যায়(১) আয় চঁদ মামা টিপ দিয়ে যা/ চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা।(২) খোকন খোকন ডাক পারি / খোকন মোদের কার বাড়ি /আয়রে খোকন ঘরে আয় / দুধ মাখা ভাত কাকে খায়।(৩)আতা গাছে তোতা পাখি/ডালিম গাছের মৌ/এত ডাকি তবু কাথা/কওনা কেন বউ ।এই ছড়াগুলির ধ্বনি শব্দের ্ঝঙ্কার শিশুমনকে আকর্ষণ করে,শিশুমনের অস্থিরতা দুর করে তাকে নিয়ে যায় কল্পনার রঙিন রাজ্যে । এভাবেই শিশু কল্পনার রাজ্যে বিচরণের সুযোগ পায়। ফলে তার মনোজগতে এক প্রশান্তির অনুভূতি তৈরি হয় এবং তার কল্পনাশক্তি বৃদ্ধি পায়।ছড়াকার প্রবাদ পুরুষ সুকুমার রায়,চন্দ্রাবতি, মুন্সি আব্দুর রহিম,কবি আজহারুল ইসলাম,মনিরুদ্দীন ইউসুফ,আবিদ আজাদ এদের সুযোগ্য উত্তরসূরি হিসাবে এযুগেও অনেক ছড়াকার ছড়াসাহিত্যের নিবেদিত প্রাণ ছড়াকার হিসাবে এখনও ছড়া লিখে যাচ্ছেন।এদেশের অনগ্রসমরমাণ জনগোষ্ঠীর এমন অনেক পরিবার আছে যারা তাদের সন্তানের প্রতি যথাযতভাবে দায়িত্ব পালনে স্বক্ষম নয়।ফলে এসকল পরিবারের ছ্ট্টো শিশুটি যখন খেয়ে পড়ে বাঁচার তাগিদে মোটে মজুরের কাজ করে তখন মালিক কর্তৃক শিশুর প্রতি যে নির্মম আচরণ ও নির্যাতন করা হয় তা দেখে অনেকের চোখেই পানি আসে ঘটনা দুর্ঘটনা ঘটার পর আলোচনা সমালোচনা হয়, পত্র পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়। এই ভাবনায় আজকের প্রজন্মের ছড়াকার সাদেক আহমেদ এইভাবে তা বর্ণনা করেছেন-শিক্ষা লাভের অধিকার আছে সকল শিশুর/তবে কেন রাস্তা-ঘাটে ঠেলছে ঠেলা কিশোর?/পেটের দায়ে কেউবা তাদের ভাঙছে দেখি পাথর/অনাহারে আছে শিশু ক্ষুধার জ্বালায় কাতর।ভাত কাপড়ের আশায় শিশু নানা কাজে লিপ্ত/নির্যাতনের খড়গ চালায় হয়ে মালিক ক্ষিপ্ত। শিশুর প্রতি সহিংসতা করতে দেখি যাদের /উঁঁচু তলা মানুষ হলেও ঘৃণা জানাই তাদের।এদেশের বৃহৎজনগোষ্ঠীর জীবন যাপনের জন্য যাকিছু প্রয়োজন তা উৎপাদনের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত লোকের সংখ্যা ভোক্তার তুলনায় নেহাত কম । তাই উৎপাদন প্রণালীর বাইরে বিপনন কাজে জড়িত অসাধু ব্যবসায়িদের অপতৎপরতার কারণে ফল-মূল,শাক-সব্জী, মাছ তরকারিসহ নানা পণ্যে ক্ষতিকারক রাসায়নিক দ্রব্য মিশিয়ে বিক্রয় করে থাকে।ফলে দুরারোগ্য রোগের সৃষ্টি হয় ছড়ার মাধ্যমে এভাবে এযুগের ছড়াকার শুকরানা ইসলাম বর্ণনা করেন-
মধু মাসে বাজারেতে কত কত ফল/আম,জাম লিচু দেখে জিভে আসে জল/কার্বাইড দিয়ে ফল পাকে তাড়াতাড়ি/অসাধু ব্যবসায়িরা বলে খেতে মজা ভারি/ফরমালিন দিয়ে তারা রাখে ফল তাঁজা/অপরাধ করে যায় পায় না তো সাজা/বাহারি রঙের ফল করে সর্বনাশ/মিশে যায় বিষ তাতে এলে মধু মাস/প্রতারক ব্যবসায়ী হয়ে যায় অন্ধ
বাজারের ফল দেখে করি চোখা বন্ধ।
ছড়াসাহিত্য মানবতার ধারণাকে পূঁজি করে প্রতিকূল পরিবেশে মনুষত্ব বিসর্জন দেয়ার বদলে সত্য ন্যায়ের সংগ্রামে নিজেকে বিজয়ি দেখার প্রেরণা দেয়,নতুন সৃষ্টির সম্ভবনায় ব্যক্তি ও জাতিকে এগিয়ে যাবার পথ দেখায়।মানুষের মনে দয়া,মায়া,ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধের প্রদীপ জ্বালায়।কল্পনা, বাস্তবতা আর যুক্তির নান্দনিক উপস্থাপনায় ছড়া মানুষের মনে নব চেতনা জাগায়,নিজের ও আশেপাশের মানুষের অপরিসীম সম্ভবনাকে উদ্ভাসিত করে সুখী সমৃদ্ধ জাতি গঠনে সহায়তা করে।এমন এক সময় ছিলো যখন অশিক্ষিত লোকেরা মুখে মুখে কথায় কথায় ছড়া কাটতো যাপিত জীবনের পরিবেশ পরিস্থিতে\ আজ আর সেই দিন নেই এখন মানুষ এখন মানুষ ছড়া লিখে কাগজে,কম্পিউটারে,এন্ড্রয়েড মোবাইল ফোন, ট্যাব ইত্যাদি নানা মাধ্যমে। মুহূর্তেই এই সকল ছড়া ইথারে ছড়িয়ে দেন বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষের কাছে ফেইসবুক,টুইটার,ইউটিউব ইত্যাদির মাধ্যমে।তাই এই শক্তিশালী সহিত্য মাধ্যমকে আরও বেশি গুরুত¦ দিয়ে আরও বেগবান করার জন্য সাহিত্য কর্মি ও সমাজমনষ্ক সবাইকে এগিয়ে আশা দরকার।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন